Saturday, April 24, 2010

MIGRANT VOTER

ওঁরা মাইগ্রেন্ট, ওঁরা ভোটার নয়

চন্দন দে

শিবপুরী

২২শে নভেম্বর, ২০০৮— ডেটলাইন কী হবে, তা নিয়ে মহা ধন্দ।

গোয়ালিয়র থেকে শিবপুরী যাওয়ার পিচঢালা রাস্তা। বাঁদিকের জানলাজুড়ে যত দূর দৃষ্টি চলে, শুধুই রুক্ষতার বড়োসড়ো বিজ্ঞাপন, শুধুই এবড়ো-খেবড়ো। ডাইনে তবু খানিক সবুজ, কাছে-দুরের পাহাড় তুলোট কাগজে ওয়াসের ছবির মতো ঝাপসা।

সেপথের ধারেই তাঁবু পড়েছে ওঁদের। গাড়ি থামতেই মহিলার দল আড়াল-তফাত। ‘বলতে চাই না, চাই না’— করেও অনেক কথা বলে ফেললেন অমর সিং, হেমরাজরা। ঘরছাড়া মানুষের এই দলটায়

১৩জন ‘জেন্টস’ আর তেরো জন ‘লেডিজ’। বাচ্চা-কাচ্চার সংখ্যা জানতে গিয়ে অবশ্য হিমসিম খেলো। তিন মরদ মিলে জনে জনে জিজ্ঞাসা করে জানিয়ে দিলেন— ষোলো।

বৃত্তান্ত সেই একই। এরা ঘর ছেড়েছেন আহ্লাদে নয়, অভাবের তাড়নায়। এসেছেন সেই রায়সেন জেলা থেকে। গ্রামের নাম কুন্ডরী। দেওয়ালি মিটতেই আশপাশের গোটা তল্লাটের গাঁ-ঘরের বেশিটাই খালি। কেউ এসেছেন পরিবারজুড়ে, কেউ বা একাই। আসতে পারেননি বয়স্করা। পাঠিয়ে দিয়েছেন ছেলেপিলেদের, এমনকি যুবতী মেয়েদেরও। কোনো কোনো মহিলা অবশ্য গ্রামেই থেকে গিয়েছেন, গরু-ছাগল দেখার জন্য।

আসলে কী আর করবেন। চাষ করে যা আয় হয়, তাতে কুলোয় না। সেচের জল বলে কোনো কালে কিছুই ছিল না ভিল আদিবাসীদের ঐ জমিতে। বৃষ্টি হলে চাষ, না হলেই সর্বনাশ। খেতে যা ফসল হয়, তাতে তিন-চার মাসের বেশি চলে না।

তাই সোয়াবিন তুলেই সোম সিংরা নেমে পড়েছিলেন ‘সর্দার’-র খোঁজে। তবে খুঁজতে হয় না বেশি। গ্রামের ধারেকাছেই তাকেন এই সর্দাররা। তাঁরাই সব সুলুক-সন্ধান দেন। কোথায় গেলে কাজ মিলবে, কত মজুরি পাওয়া যাবে— এই সব। এরাই ট্রেনে চাপিয়ে দলকে দল মানুষকে নিয়ে যান কাজের খোঁজে। বদলে সর্দার পান মজুরির একটা অংশ। তেমন খোঁজ পেয়েই এখানে ওঁরা এসেছেন এক বেসরকারী টেলিকম কোম্পানির লাইন ফেলার কাজে।

কত টাকা নিয়ে ফিরতে পারবেন? মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করলেন অমর, সোমসিংরা। বোঝা গেলো সবটাই আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া। একট গভীরে বোঝার তাগিদে জানা গেলো, ‘দেখুন এক মিটার গর্ত করে বোঝাই করা পর্যন্ত শেষ করলে ৫০টাকা পাওয়া যায়। ছেলেরা গর্ত খোঁড়ে, মেয়েরা মাটি সরায়। গোটা দিন কাজ করলে দু’জনে মিলে একশো টাকা হয়ে যায়।’

ঘুরতে ঘুরতে ভোপাল হয়ে পৌঁছে যাওয়া গেলো রায়সেন জেলায় অমর সিংদের গ্রামে। বাড়িতে ওর বৃদ্ধ বাবা-মা, আর দেখভালে অমরের ন’বছরের মেয়ে। গোটা গ্রাম খাঁ খাঁ করছে। তবু তার মধ্যেই চোঙা ফুঁকে চলেছে ভোটওয়ালা অটো রিকসা, ভোটের হাওয়া তুলতে। কিন্তু ভোটের প্রচারের কথা শুনতে হাজির নেই এ তল্লাটের বহু গ্রামের মানুষ। পেটের দায়ে তাঁরা অন্যত্র পাড়ি দিয়েছেন। ভোটের আগে ফিরেও আসবেন না।

প্রশ্ন ছিল হেমরাজকে, ভোটে ফিরবেন না গ্রামে? বললেন, ফিরতে হলে তো যা কামিয়েছি গোটাটাই চলে যাবে।

তাহলে এই বাছা বাছা প্রতিশ্রুতির কী হবে? বি জে পি যে সেদিন কোন্ডরায় বলছিল, ‘সরকার তোমাদের জন্য কতকিছু করছে, আরো অনেক কিছু করবে।’ আর কংগ্রেস বলছে, ‘তোমাদের জন্য ওরা কিছুই করলো না। আমাদের ভোট দাও, আমরা করবো।’

কিন্তু ঘরছাড়া মানুষ জানেন, ভোটপর্ব মিটলেই এদের টিকি মিলবে না। আবার সেই রুটি-ভাতের তাগিদে অন্য গ্রামে, অন্য জেলায়, কখনও অন্য রাজ্যে পাড়ি। হেমরাজের প্রশ্ন, ‘আদিবাসী কা কৌন শৌচতা হ্যায়।’

No comments:

Post a Comment